সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দে ভারতবর্ষে সিন্ধু নদের তীরে গড়ে উঠেছিলো একটি সভ্যতা। তাই এটি সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত। বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ; ভারতের গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা ও পাঞ্জাব রাজ্য; দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্থান এবং ইরানের বেলুচিস্তান প্রদেশের পূর্ব অংশ এই সভ্যতার অন্তর্গত ছিলো। এ প্রাচীন সভ্যতাটি প্রথম আবিষ্কার হয় ১৯২১ সালে। সভ্যতাটি আবিষ্কার করেন স্যার জন মার্শাল এবং রায় বাহাদুর দয়ারাম সানি। মাটি খুঁড়ে প্রথম যে শহরটির খোঁজ পাওয়া যায়, সেটি ছিলো সিন্ধু নদের তীরে হরপ্পা নগরী। এটি বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে অবস্থিত। ১৯২২ সালে লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারো নগরীর মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করা হয় আরেকটি সমৃদ্ধ নগরীর ধ্বংসাবশেষ। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানের আরো অঞ্চলে এ সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার হয়। এতে ধারণা করা হয়, সিন্ধু সভ্যতা বিস্তৃত ছিলো প্রায় ১২,৬০,০০০ কিলোমিটার যায়গা জুড়ে, যা ছিলো বিশ্বের বৃহত্তম প্রাচীন সভ্যতা। ধারণা করা হয়, সিন্ধু সভ্যতা যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে তখন সেখানে ৫০ লাখেরও বেশি অধিবাসী ছিলো।
নগর পরিকল্পনা
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো প্রায় একই পরিকল্পনায় গড়ে উঠেছিলো। এ সভ্যতায় নগররাষ্ট্র দুটি অংশে বিভক্ত ছিলো। এক অংশে সাধারণ নাগরিকরা বসবাস করতো এবং অন্য অংশতি ছিলো দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এ অংশটি সমতল ক্ষেত্র থেকে কিছুটা উঁচুতে ছিলো। ধারণা করা হয়, সম্ভ্রান্ত রাজপুরুষ এবং পুরোহিতরা এ অংশটিতে বসবাস করতেন। নগরীর বাড়িগুলো ছিলো পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি। নগরীর ভেতর ছিলো পাকা রাস্তা। প্রধান রাস্তাটি ছিলো ৩৫ ফুট প্রশস্ত। রাস্তার ধারে ছিলো সারিবদ্ধ ল্যাম্পপোস্ট। ময়লা ও পানি নিষ্কাশনের জন্য মাটির নিচে ড্রেন বসানো হয়েছিলো। সিন্ধু সভ্যতায় যে আধুনিক নগরব্যবস্থা ছিলো অন্য কোনো অন্য কোনো প্রাচীন সভ্যতায় তেমনটা দেখা যায়নি।
স্থাপত্য
সিন্ধু সভ্যতায় চমৎকার সব নিদর্শন রয়েছে। মহেঞ্জোদারোর বৃহৎ মিলনায়তন ছিলো একটি চমৎকার স্থাপত্য। ধারণা করা হয়, এটি ছিলো একটি সভাগৃহ। ৮০ ফুট যায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছিলো এ মিলনায়তনটি। এতে ছিলো সারিবাঁধা বেঞ্চ আর সামনে মঞ্চ। এছাড়াও ২৩০*৭৮ ফুট আয়তনের একটি প্রাসাদ পাওয়া গেছে মহেঞ্জোদারোতে। ধারণা করা হয় এ প্রাশাদে প্রশাসক শ্রেণির বসবাস ছিলো। মহেঞ্জোদারোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য তাদের বৃহৎ স্নানাগার। বর্গাকার এই ঘরটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ছিলো ১৮০ ফুট করে। ঘরের কেন্দ্রে ছিলো সাঁতার কাটার উপযোগী প্রকাণ্ড চৌবাচ্চা। স্নানাগারের চারপাশে ছিলো ঘোরানো বারান্দা। স্নানাগারের মূল কক্ষটি ছিলো দোতলা।
ধর্ম
ধারণা করা হয়, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অনুসারী ছিলেন। এ সভ্যতায় কোনো ধর্মীয় মন্দির বা ভবন ছিলো না। যদি সেখানে কোনো মন্দির থেকেও থাকে তা এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। ঐতিহাসিকদের মতে, সিন্ধু সভ্যতায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিসহ ষাঁড়, কুমির, সাপ ও গাছের পূজা করা হতো।
ভাস্কর্য
সিন্ধু সভ্যতায় দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য হতো। পাথর ও ব্রোঞ্জের প্রচুর ভাস্কর্য পাওয়া গেছে এ সভ্যতায়। চুনাপাথরের তৈরি একটি মাথা ও মুখমণ্ডল পাওয়া গেছে। পাথর কেটে চমৎকার ঢেউ খেলানো চুল তৈরি করা হয়েছে সেটিতে। ঠোঁট আর কান তৈরি করা হয়েছে অত্যান্ত নিখুঁতভাবে। মানুষের ভাস্কর্য ছাড়াও বেশ কিছু পশুর ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। এ থেকে বোঝা যায়, সে সময়কার ভাস্করগণ অত্যান্ত দক্ষতার সাথে নিপুণ হাতে ভাস্কর্য তৈরি করতে পারতেন।
পরিমাপ পদ্ধতি
পরিমাপ পদ্ধতি উদ্ভাবন সিন্ধু সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। পণ্য ওজনের জন্য নগরবাসীরা বিভিন্ন বাটখারা ব্যাবহার করতো। এসব বাটখারা শক্ত পাথর দিয়ে তৈরি করা হতো। বড় বড় দ্রব্য ওজনের জন্য ব্রোঞ্জের দাঁড়িপাল্লা ব্যবহৃত হতো। দৈর্ঘ্য পরিমাপের জন্য তারা স্কেল ব্যবহার করতো। ব্যাবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ সভ্যতার অধিবাসীরা এসব উন্নত পরিমাপ পদ্ধতি ব্যবহার করতো।
সিলমোহর ও লিপি
সিন্ধু সভ্যতায় সিলমোহরের ব্যাপক ব্যাবহার ছিলো। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে ২,৫০০টি সিলমোহর পাওয়া গেছে। বাণিজ্য ও ধর্মীয় কাজে এ সমস্ত সিলমোহর ব্যাবহার করা হতো বলে ধারণা করা হয়। পাথরের তৈরি এ সিলমোহরগুলোর অধিকাংশই চারকোণাকৃতির। সিলমোহরগুলোতে ষাঁড়, মহিষ ইত্যাদি পশুর প্রতিকৃতি ছিলো। তাছাড়া ছিলো বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন। এ চিহ্নগুলোকে একধরনের লিপি বলে মনে করা হয়। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় যে লিপি ব্যবহৃত হতো তা আজও পড়া সম্ভব হয়নি।
অর্থনীতি
কৃষি ছিলো সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের প্রধান জীবিকা। গম ও যব ছিলো তাদের প্রধান শস্য। এছাড়া খেজুর, বদরী, আঙ্গুর এবং আনারসও উৎপাদিত হতো। পাশাপাশি কার্পাসের চাষ ভালো করা হতো। এ অঞ্চলের মাটি খুবই উর্বর ছিলো এবং সেচ ব্যবস্থজা ছিলো দেশ উন্নত। কৃষিক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো সে সময়কার কৃষি যন্ত্রপাতি। লাঙল আবিষ্কারের ফলে উৎপাদন ক্ষমতার ব্যপক উন্নতি সাধিত হয়। সিন্ধু সভ্যতার মানুষরা বাণিজ্য ক্ষেত্রেও বেশ অগ্রসর ছিলো। সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশের সাথে তাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিলো। তারা কাঠ, হাতির দাঁত ও দাঁতের তৈরি চিরুনি, সুতিবস্ত্র, তামা ইত্যাদি রপ্তানি করতো।
শিল্পকর্ম
সিন্ধু সভ্যতার সময়ের শিল্পকর্মের মধ্যে হাতির দাঁত ও হাড়ের তৈরি চিরুনি ও সুচ, তামা ও ব্রোঞ্জের তৈরি ছুরি, ক্ষুর, কুঠার, কাস্তে ইত্যাদি পাওয়া গেছে পোড়ামাটির তৈরি মানুষের মূর্তি, পুতুল, গরু, মহিষ, কুকুর, ভেড়া, কুমোরের চাক ইত্যাদি।
সিন্ধু সভ্যতার পতন
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫০ অব্দ থেকেই সিন্ধু সভ্যতার পতন শুরু হয়। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, এ সময় ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যায় হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগর দুটি ধীরে ধীরে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়।
পোস্টটি লিখেছেন
আমি জয়। আমি এই ব্লগের এডমিন। ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের স্থাপত্য বিভাগের একজন ছাত্র। আমি খুলনা থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছি। আমি ব্লগ লিখি এবং আমি একজন ইউটিউবার। এর পাশাপাশি আমি গ্রাফিক ডিজাইন এর কাজ করি। ঘুরে বেড়ানো এবং সিনেমা দেখা আমি খুব পছন্দ করি।
Follow her @ Twitter | Facebook | YouTube
No comments
পোস্টটি কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে জানাতে পারেন । আপনাদের কোন সমস্যাও কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমরা যতটুকু সম্ভব সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবো ।