মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস।


আজ থেকে প্রায় ৭,৩০০ বছর আগে সমগ্র পৃথিবীতে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বন্যায় ফসলের ব্যপক ক্ষতির ফলে মানুষ চরম সংকটে পড়ে। তখন নাইল নদের তীরে বসবাসরত প্রাচীন মিশরীয়রাও এই সংকটে পড়েছিলো এবং সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছিলো। বন্যা প্রতিরোধে তারা নাইল নদের তীরে বাঁধ দেয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। আর খাল কেটে বন্যার পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করে, যেনো শুকনো মৌসুমে তা কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিশরে গড়ে ওঠে সেচ ব্যবস্থা। আর এ সেচ ব্যবস্থা অনেক মানুষের প্রয়োজন ছিলো নাইল নদের চারপাশে দলে দলে মানুষ জড় হতে লাগলো। এর মধ্যেই সেখানে তামা ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ার তৈরির ছোট ছোট কারখানা গড়ে ওঠে। এ সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রাচীন মিশরীয়রা একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। প্রশাসনের প্রধান হলেন দলপতি। তাঁকে সবাই মান্য করতো। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো রাষ্ট্র, এর রাষ্ট্রের প্রধান হলেন রাজা। রাজাদের বলা হতো ফারাও। রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার ফলে অনেক রাস্তাঘাট ও দালানকোঠা তৈরি হলো। ফলে গ্রাম্য কাঠামোর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে থাকলো এবং গড়ে উঠলো নগর। আর এভাবেই মিশরে নগর সভ্যতার সূচনা ঘটলো। নাইল নদকে কেন্দ্র করে এ সভ্যতা গড়ে উঠেছে বলে গ্রিক ঐতিহাসিক 'হেরোডোটাস' মিশরকে 'নাইল নদের দান' হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

প্রাক-রাজবংশীয় যুগ 

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়ের মিশরকে বলে হয় প্রাক-রাজবংশীয় যুগ। এ সময় মিশর কতকগুলো ছোট ছোট নগররাষ্ট্রে বিভক্ত ছিলো। এগুলোকে বলা হতো 'নোম'। খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে 'মেনেস' নামের এক রাজা সমগ্র মিশরকে একত্রিত করে একটি একক রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। এর রাজধানী ছিলো 'মেম্ফিস'। এভাবে মিশরে রাজবংশীয় যুগের সূচনা হয়।

ফারাও

প্রাচীন মিশরে রাজাদের বলা হতো 'ফারাও'। মিশরীয় 'পের-ও' শব্দ থেকে 'ফারাও' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ফারাওরা নিজেদের সূর্যদেবতার বংসধর বলে মনে করতেন। তারা ছিলেন একাধারে দেবতা, প্রাশাসনিক প্রধান, বিচারক, প্রধান সেনাপতি এবং প্রধান পুরোহিত। মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো, ফারাও হলেন তাদের জীবিত ঈশ্বর। ফারাওদের অধিকাংশই ছিলো পুরুষ। তবে কয়েকজন নারী ফারাও-ও ছিলেন, যার মধ্যে 'হ্যাটশেপসুট' ছিলেন সুপরিচিত। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৪৭৩ থেকে ১৪৫৮ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। কোনো ফারাও-এর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তার পুত্র বা কন্যা সিংহাসনে বসতে পারতেন না।

ধর্ম 

প্রাচীন মিশরে সভ্যতা বিকাশে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। তারা সূর্য, চন্দ্র, বজ্র, ঝড়, বন্যা, বায়ু এবং বাঘ, সিংহ, সাপ, কুমির, হরিণ, বাজপাখি, বানর এমনকি বিড়ালেরও পূজা করতো। মিশরীয়দের ধারণা ছিলো সূর্য দেবতা 'রে' বা 'আমন রে' এবং প্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নাইল নদের দেবতা 'ওসিরিস' মিলিতভাবে সমগ্র পৃথিবী পরিচালনা করেন। মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো যে, মানুষের মধ্যে 'বা'  অর্থাৎ আত্মা এবং 'কা' অর্থাৎ দ্বিতীয় সত্ত্বা আছে। মৃত্যুর পর 'বা' ও 'কা' ফিরে এসে দেহকে পুনরুজ্জীবিত করবে এবং তাদের পাপ-পুণ্যের বিচার করবেন দেবতা 'ওসিরিস' ধর্ম পালনের জন্য প্রাচীন মিশরে মন্দির তৈরি করা হতো। 'কারনাক মন্দির' ছিলো তাদের সবচেয়ে বড় মন্দির। এখনো পর্যন্ত এটিই পৃথিবীর প্রথম নির্মিত বৃহত্তম ধর্মীয় উপাশনালয়। মিশরীয় সভ্যতার অবসানের যুগে সুবিধাভোগী পুরোহিতরা ধর্মের নামে প্রতারণা করতে থাকেন। ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ এসব প্রতারকদের হাট থেকে ধর্ম রক্ষায় এগিয়ে আসেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭৫ অব্দে তিনি ক্ষমতায় এসে পুরোহিতদের মন্দির থেকে বের করে দেন। বহু দেবতার পরিবর্তনে তিনি কেবল সূর্য দেবতার আরাধনার কথা প্রচার করেন। সূর্যদেবতার নাম দেয়া হয় 'এটন'। দেবতার নামের সাথে মিল রেখে তিনি নিজের নাম রাখেন 'ইখনাটন'। এভাবেই তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম ধারণা দেন এবং চালু হয় একেশ্বরবাদী ধারণা।

কৃষি 

প্রাচীন মিশরের অর্থনীতির মূল উৎস ছিল কৃষি। তাদের কৃষিকাজ নাইল নদের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল ছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা তিনটি ঋতু, চিহ্নিত করেছিলো, আখেত ( বন্যাঋতু ), পেরেত ( রোপণ ঋতু ) এবং শেমু ( ফসল কাটার ঋতু )। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০০ অব্দে মিশরীয়রা কৃষিকাজে লাঙলের ব্যবহার শুরু করে। কৃষিকাজের জন্য তারা প্রথম বাঁধ দেওয়া, স্লুইস গেইট নির্মাণ করা, খাল কেটে পানি সংরক্ষণ করা এবং 'শাদুফ' নামে এক ধরনের কপিকল আবিষ্কার করে। তখন তারা গম, যব, পেঁয়াজ এবং তুলা চাষ করতো।

লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন 

নগর সভ্যতার বিকাশের শুরুতে মিশরীয়রা লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন করে। প্রথম দিকে ছবি এঁকে তারা তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতো। এক একটি ছবি ছিলো এক একটি অক্ষরের প্রতীক। তাই এই লেখার নাম ছিলো চিত্রলিপি। মিশরীয় এ চিত্রলিপিকে বলা হয় 'হায়ারেগ্লিফিক', যার অর্থ পবিত্র লিপি। এ লিপিগুলো ব্যবহার করা হতো ধর্মবাণী লেখা ও রাজার আদেশ প্রচারের উদ্দেশে।

ক্যালেন্ডার উদ্ভাবন 

ক্যালেন্ডারের উদ্ভাবন ও বিকাশে মিশরীয় সভ্যতার অবদান অপরিসীম। মিশরীয়রাই প্রথম মৌসুমের সাথে মিল রেখে সময় গণনার আধুনিক পদ্ধতি চালু করে। তারা বছরকে ৩০ দিনবিশিষ্ট ১২ মাসে ভাগ করে এবং বছর শেষে ৫ দিন যুক্ত করে ৩৬৫ দিন হিসেবে বছর গণনা করতো।

ঘড়ি আবিষ্কার 

মিশরীয়রা সূর্যের আলোর ছায়া মেপে দিনের সময় নিরূপণের যন্ত্র আবিষ্কার করে, যার নাম সূর্যঘড়ি। কিন্তু সূর্যঘড়ি রাতে কাজ করতো না। দিনের বেলায়ও  সূর্য না উঠলে কাজ করতো না। তাই তারা সময় পরিমাপের জন্য আরেকটি যন্ত্র আবিষ্কার করে, যার নাম পানিঘড়ি। গ্রিকরা এ ঘড়ির নাম দিয়েছিলো কেপসাইড্রা।
নাইমুল ইসলাম

পোস্টটি লিখেছেন
আমি জয়। আমি এই ব্লগের এডমিন। ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের স্থাপত্য বিভাগের একজন ছাত্র। আমি খুলনা থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছি। আমি ব্লগ লিখি এবং আমি একজন ইউটিউবার। এর পাশাপাশি আমি গ্রাফিক ডিজাইন এর কাজ করি। ঘুরে বেড়ানো এবং সিনেমা দেখা আমি খুব পছন্দ করি।
Follow her @ Twitter | Facebook | YouTube

No comments

পোস্টটি কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে জানাতে পারেন । আপনাদের কোন সমস্যাও কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমরা যতটুকু সম্ভব সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবো ।

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.